• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ড্রেজার-জলযান সংগ্রহে হোঁচট

  • তরিকুল ইসলাম সুমন
  • প্রকাশিত ২১ এপ্রিল ২০২৪

দেশের নদীগুলোর নাব্য ফেরাতে প্রয়োজনীয় জলযান ও আর্থিক সংস্থানের অভাব রয়েছে। অগ্রাধিকার ও নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির পরেও বড় প্রকল্প ‘৩৫ ড্রেজার ও সহায়ক জলযান এবং সরঞ্জমাদি সংগ্রহ’ হোঁচট খাচ্ছে সরকার। বৃদ্ধি করা হয়েছে মেয়াদও। এ অবস্থায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২২.৪১ শতাংশ। সবমিলিয়ে সংকটে পড়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সর্বাধিক বড় এই প্রকল্প।

বরাদ্দ হওয়া ২৭০ কোটি টাকার মধ্যে অর্থ ছাড় হয়েছে ১৬২ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা। ফলে সংকটকো কাটছেই না রবং প্রয়োজনীয় ড্রেজার না থাকায় ভাড়া করা ড্রেজারের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়কে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও কার্যক্রম খুব একটা অগ্রসর হয়নি। যার মেয়াদ ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। যা পরবর্তীতে ২৫ এর জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। করোনা পরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কার্যাদেশ দিয়েও তাদের প্রয়োজনীয় টাকা দিতে পারছে না সংস্থাটি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, বিশেষ করে দেশের নদীতে জমে থাকা পলিথিন ও বর্জ্য অপসারণের জন্য ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নেদারল্যান্ড থেকে একটি গ্রাব ড্রেজার সংগ্রহের চুক্তি করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে কার্যাদেশও। কার্যাদেশ অনুযায়ী চলতি বছরের মাঝা-মাঝি পাওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। এটির কার্যক্ষমতা হলো ১ গ্রাব সমান ১৫ ঘনমিটার বা ৩০ টন। অর্থাৎ প্রতিবারে এটি পানিসহ ৩০ টন বর্জ্য উত্তোলন করতে পারবে।

নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নৌপথের সুদিন ফেরাতে নতুন নতুন নৌপথ সৃষ্টি, ফেরি সার্ভিস চালুসহ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের বিকাশেও ভূমিকা রাখছে দেশের নৌপথ। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন। এ কাজটি একটি চলামান প্রক্রিয়া। আমাদের টার্গেট ঠিক আছে আমরা বাংলাদেশে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ তৈরি করবো। নৌ যোগাযোগের জৌলুস ফিরিয়ে আনতে আমাদের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) মাধ্যমে বেশ কিছু ক্রুজ শিপ, ১২টি আধুনিক ফেরি, আটটি উন্নতমানের সি-ট্রাক, চারটি উপকূলীয় যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণাধীন এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) তত্ত্বাবধানে ‘৩৫ জলযান সংগ্রহের কাজ চলছে। কিন্তু এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের ঘাটতি রয়েছে। এগুলো এলে আমাদের ড্রেজিংয়ে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। ড্রেজিং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ পর্যন্ত ৩৮টি ড্রেজারসহ ২৩টি নদী সংরক্ষণ সহায়ক জলযান সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই খাকে আরো বড় ধরনের ড্রেজার ও জলযান যুক্ত হবে। কিন্তু কোভিড ১৯ এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের এ সমস্যার সমাধান হবে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭৮টি নদীর নাব্য সংরক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এ সংস্থার বহরে ড্রেজার রয়েছে ৪৫টি। এগুলো পুরাতন হওয়ায় অনেকেরই কর্মক্ষমতা লোপ পেয়েছে। যা দিয়ে বার্ষিক ৬.৮৯ কোটি টন পলি অপসারণ করা সম্ভব। নতুন করে ৩৫টি যুক্ত হলে এ সংস্থার বার্ষিক ড্রেজিং ক্ষমতা হবে ১৩.৩৬ কোটি টন। প্রকল্পের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশসহ ২৮ ইঞ্চি ২টি, ২৪ ইঞ্চি ৮টি, ২০ ইঞ্চি ৮টি, ১৮ ইঞ্চি ৯টি ও ১২ ইঞ্চি ২টি কাটার সাকশন ড্রেজার, ২টি ট্রেইলিং সাকশন হোপার ড্রেজার, ২টি ওয়াটার ইনজেকশন/জেটিং ড্রেজার এবং ২টি সেলফ প্রপেল্ড পন্টুন মউনটেড গ্রাব ড্রেজার সংগ্রহ করা হবে। একই সঙ্গে ৩৫টি ক্রেনবোট, অফিসার ও ক্রু হাউজবোট ৩৫টি, পাইপ কেরিং ডাম্ববার্জ ১৫টি, টাগবোট ১৭টি সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া ৫টি করে ওয়েল ও ওয়াটার বার্জ, ১০টি সার্ভে ওয়ার্কবোট, ২টি ইন্সপেকশন ভেসেল, ১টি কেবিন ক্রুজার, ২ লাখ ৩৮ হাজার বর্গমিটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ড্রেজার বেইস, অফিসার ও স্টাফ কোয়ার্টার এবং ডরমিটরি নির্মাণ করা হবে।

অপরদিকে প্রায় ৩৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২টি ২৮ ইঞ্চি ব্যাসের ড্রেজার সংগ্রহের জন্য চলতি মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এগুলো প্রতি ঘণ্টায় ২২শ ঘন মিটার বা ৪৩৭৮ টন পলি বা বালি অপসারণ করতে পারবে। খুলনা শিপইয়ার্ড ৪টি ২৪ ইঞ্চি ব্যাসের ড্রেজার তৈরির কাযাদেশ পেয়েছে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু ড্রেজার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আরো বলেন, দেশের নদ নদী দখল ও দূষণ রোধের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। নদীকে তার রূপ ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সকল কিছুই আমরা হাতে নিয়েছি। এরই একটি হচ্ছে নদ-নদীর নাব্য ফেরাতে ৪,৪৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের অনেক প্রকল্পে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। যাতে করে কোনো বড় প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এখন হয়তো কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি ভালো হলে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হবে।

অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এক সময় ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ থাকলেও দেশে এখন (শুষ্ক মৌসুমে) ৬ হাজার ১৯২ কিলোমিটার নদীপথ রয়েছে। যে পথে নৌযান চলাচল অব্যাহত রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. রকিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, একটা সময়ে এই অঞ্চলে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। যা স্বাধীনতার পরে আরও কমেছে। তাই বর্তমান সরকার নৌপথ উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা নিয়ে নদী খনন করছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া মংলা-ঘষিয়াখালী (এমজি) চ্যানেল ড্রেজিং করে ২০১৫ সালে নৌযান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই চ্যানেল দিয়ে ভেসেল (বড় জাহাজ) ৮-১৪ ফুট গভীরতায় চলাচল করছে। এক সময় নাব্য সংকটে খাগদোন, লাউকাঠি, ভোলা নালা, কীর্তনখোলা, ইছামতি, কর্ণতলী দিয়ে কার্গো লঞ্চ চলাচল করতে না পারলেও এখন সারা বছর চলাচল করছে।

তিনি আরো বলেন, শুধু ড্রেজিং বা খনন করলেই হবে না। এ জন্য সারা বছর মেইনটেনেন্স ড্রেজিং করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজনীয় ড্রেজার আমাদের নেই। ভাড়া করতে হচ্ছে। এ জন্য আবার প্রযোজনীয় বরাদ্দও থাকছে না। এ কারণে আমাদের ড্রেজিং করা অনেক নৌ রুট আবার পলি পড়ে ভরাট হতে শুরু করেছে।

বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. রকিকুল ইসলাম তালুকদার আরো জানান, দেশের নদ-নদীর নাব্য সংরক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট চলাচল উপযোগী রাখার জন্যই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে করোনা আমাদের এ গতিধারাকে শ্লথ করে দিয়েছে। একদিকে অর্থ সংকট অন্যদিকে বিশ্বমন্দার কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে না পাড়ায় সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি আশা করেন, বর্ধিত সময়েই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছাইদুর রহমান বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করতে আমাদের নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। দেশের এমন কিছু জায়গা আছে যে সব জায়গায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে চায় না। যায় না ড্রেজিং করা, মাটি ও পাথরের কারণে ড্রেজার নষ্ট হচ্ছে। নাব্য সংকট, পলি জমা, অবৈধ দখলসহ নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে অনেক নদ-নদী। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী বেশির ভাগ নদীর বুকজুড়ে এখন ফসলের ক্ষেত। ব্রহ্মপুত্র নদের প্রশস্ততা ছিল ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার। আজ তা ভরাট হতে হতে স্থানভেদে ১০০ থেকে ২০০ মিটারে ঠেকেছে। কোথাও হেঁটেই পারাপার হচ্ছে মানুষ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads